ঢাকা ১১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাস ও ঐতিহ্যময় সালাম সৃষ্টির শুরুতে আদম (আ.) থেকে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:২৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭
  • ৫৩০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের মাঝে যে সালামের প্রচলন তার সূচনা সৃষ্টির শুরুতে আদম (আ.) থেকে। সব নবী-রাসুল এই সালামের পরিচর্যা করেছেন। কাজেই আমরা যখন পরস্পর সালাম বিনিময় করি তখন শুধু একে অপরের জন্য শান্তিই কামনা করি না; বরং মানব ইতিহাস ও সভ্যতার সঙ্গে নিজের চেতনাকে শামিল করি। তার মানে সালামের চর্চা আমাদের বিশ্বসভ্যতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে একাকার করে। আমরা নবী-রাসুলদের আচরিত সংস্কৃতির মাঝে মিশে যাই

বিদেশের মাটিতে প্রথম পা রেখে প্রত্যেকের মাথায় চিন্তা জাগে দুইটি কীভাবে নিজের পরিচয় তুলে ধরব, তারপর কী করে পরিচিত কাউকে খুঁজে বের করব। সমস্যাটি প্রকট হয় যখন কেউ এমন কোনো দেশে ভ্রমণে যায়, যেখানকার ভাষা তার জানা নেই কিংবা তার মুখের বুলি কেউ বোঝে না। এই সংকটের অবসান ঘটিয়ে পরবাসীর জন্য নানা সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে একটি বাক্য।

তা হচ্ছে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’। ইসলামী সংস্কৃতির সৌন্দর্যের বাহন এই সালামে প্রথম প্রকাশ পায় ব্যক্তির পরিচয়। অর্থাৎ তিনি মুসলমান। সঙ্গে তার চিন্তা, বিশ্বাস, রুচি-প্রকৃতির পরিচয় ফুটে ওঠে স্বাগতিকদের কাছে। এরই আলোকে তার থাকার, খাওয়ার ও অবস্থানের সুব্যবস্থা হয়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে সালামের এ গুরুত্বের ব্যাখ্যা এমন এক ভুক্তভোগীর, যিনি এমন দেশে মেহমান হয়েছিলেন, যে দেশের ভাষা তিনি বা তার ভাষা তারা জানত না।

মানব সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারায় সালামের এ গুরুত্ব আরও তাৎপর্যময়। ছোটবেলায় জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম শিক্ষকের সঙ্গে। কষ্টিপাথরের ভাঙা পায়ার ওপর পুরনো পালঙ্কের যত দেখে জানতে চেয়েছিলাম, এ ভাঙা খাটের এত কদর কেন? জাদুঘরের খোপে খোপে ভাঙাচোরা হাঁড়ি-পাতিলগুলো এভাবে সংরক্ষণ করার কারণ কী? তিনি বুঝিয়ে বলেছিলেন, এগুলো প্রততাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্যেক জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সারণি। এগুলো প্রমাণ করে একটি জাতির অতীত কত সমৃদ্ধ, ইতিহাস কতখানি গৌরবময়।

উদাহরণ দিয়ে বললেন, যে গাছের শিকড় যত গভীরে প্রোথিত, সে গাছ তত শক্ত, প্রবল ঝড়-ঝাপটা তার ভিত নাড়াতে পারে না। একটি জাতির অবস্থাও এ গাছের মতো। যে জাতির ইতিহাস যত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ, বিশ্ব সভায় সে জাতির উন্নত শিরে দাঁড়ানোর অধিকার তত বেশি। ভিন্ন জাতির আগ্রাসন বা সংকটের মোকাবিলায় শিখর হিমাদ্রির মতো শির-উন্নত থাকে সে জাতির প্রতিটি সদস্যের। আর ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনার উপাদান হচ্ছে জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত-সামগ্রী। এ জন্যই উন্নত জাতিগুলো প্রততত্ত্ব গবেষণায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে দ্বিধা করে না।

এ ক্ষেত্রে ফোকলোর ও লোকাচারগুলোর গুরুত্বও অপরিমেয়। কোনো গবেষক যদি উদ্ঘাটন করতে পারেন, ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মানব জাতির পারস্পবিক অভিবাদন রীতি কী ছিল, নিঃসন্দেহে তা হবে বর্তমান সভ্যতার জন্য বিরাট অর্জন। এ প্রেক্ষাপটে আবহমান কাল থেকে মানব সমাজে বিরাজিত সালামের গুরুত্বও নিশ্চয়ই অপরিসীম। কারণ মানব জাতির সৃষ্টির সূচনা থেকে সভ্যতার বাঁকে বাঁকে সালাম তার আবদান বিলিয়ে আসছে।

পৃথিবীতে প্রধান তিনটি ধর্ম ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্ম। ইসলামের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.)। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক ঈসা (আ.) বা যিশু আর ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক মুসা (আ.)। নবীজির আদি পিতা ইসমাঈল (আ.) আর ঈসা ও মুসা (আ.) এর আদি পিতা ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের আদি পুরুষ ইয়াকুব (আ.)। ইসমাঈল (আ.) ও ইয়াকুব (আ.) ছিলেন ইবরাহিম (আ.) এর দুই ছেলে। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের দাবি, তারা ইবরাহিম (আ.) এর অনুসারী। কিন্তু আল্লাহ পাক কোরআন মজিদে বলেছেন, মুুসলমানরাই ইবরাহিমের প্রকৃত অনুসারী। এতখানি ভূমিকার উদ্দেশ্য এ তথ্য ও সত্যটি তুলে ধরা যে, হাজার হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সম্ভাষণ ও অভিবাদনের ভাষা ছিল সালাম।

এ সাক্ষ্য জগতের সবচেয়ে নির্ভুল ও সন্দেহাতীত গ্রন্থ কোরআন মজিদের। ‘ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানের খবর কি তোমার কাছে পৌঁছেছে? যখন তারা তার কাছে এলো, তাকে তারা সালাম করল। সেও তাদের বলল, সালাম।’ (সূূরা আজ-জারিয়াত : ২৪)।

মেহমানদ্বয় ছিলেন ফেরেশতা। এসেছিলেন মানুষের রূপ ধরে একটা সুসংবাদ নিয়ে। শুধু ইব্রাহিম (আ.) নন, সব পয়গম্বরের জমানায় সালামের প্রচলন ছিল মানব সমাজে। কোরআন মজিদে সূরা সাফফাতে আল্লাহ তায়ালা হজরত নূহ, ইবরাহিম, মুসা, হারুন প্রমুখ নবীকে সালাম জানানোর কথা উল্লেখ করেছেন। (সূরা সাফফাতে : ৭৯, ১০৯, ১২০)। মানব সভ্যতার গোড়াপত্তনের শিকড় সন্ধানে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। যেতে চাই একেবারে শুরুতে। আদি পিতা আদম (আ.) এর জমানায়। বিস্ময়করভাবে আমরা দেখব যে, সালামের প্রবর্তন হয়েছে তারই মাধ্যমে।

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ.) কে তার আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন। তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তায়ালা যখন তাকে সৃষ্টি করলেন, বললেন, যাও এবং অবস্থানরত ফেরেশতাদের এ দলটিকে সালাম করো। আর তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয় শোন। তাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম-সম্ভাষণ রীতি।’ তখন তিনি গিয়ে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’ (আপনাদের প্রতি শান্তিবর্ষিত হোক)। তারা জবাবে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ (আপনার প্রতিও শান্তিবর্ষিত হোক আর আল্লাহর রহমত)।

নবীজি (সা.) বলেন, ফেরেশতারা ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বাক্যটি বৃদ্ধি করলেন। হজরত (সা.) আরও বলেন, অতএব যে লোকই বেহেশতে প্রবেশ করবে সে আদমের আকৃতিতে হবে এবং তার উচ্চতা হবে ষাট হাত। তখন থেকে এ পর্যন্ত সৃষ্টিলোকের উচ্চতা হ্রাস পেয়ে আসছে। (হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে বোখারি ও মুসলিমের বরাতে মিশকাতে)।

আদমকে (আ.) আল্লাহ তায়ালা তার আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন কথাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে চাইলে বলতে হবে আদম (আ.) এর আসল আকৃতিতে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে আকৃতি এখন সাড়ে তিন হাতে ঠেকেছে। বোঝা গেল আমাদের মাঝে যে সালামের প্রচলন তার সূচনা সৃষ্টির শুরুতে আদম (আ.) থেকে। সব নবী-রাসুল এই সালামের পরিচর্যা করেছেন। কাজেই আমরা যখন পরস্পর সালাম বিনিময় করি তখন শুধু একে অপরের জন্য শান্তিই কামনা করি না; বরং মানব ইতিহাস ও সভ্যতার সঙ্গে নিজের চেতনাকে শামিল করি। তার মানে সালামের চর্চা আমাদের বিশ্বসভ্যতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে একাকার করে। আমরা নবী-রাসুলদের আচরিত সংস্কৃতির মাঝে মিশে যাই।

ফুল আমাদরে চোখ জুড়ায়। সালাম আমাদের প্রাণ জুড়ায়। যার মনে শান্তি বিরাজিত, টেনশন-অস্থিরতা নেই, অন্যের জন্য শুভ কামনায় যার মন পুলকিত, সে-ই শুধু অন্যকে সালাম দিতে পারে। তার মনের প্রশান্তি ও ভালোবাসা উপহার দেয় অন্যজনকে, সমাজ ও সভ্যতাকে। শান্তি ও ভালোবাসার সওগাত নামে তখন সমাজে বেহেশত থেকে। আবার ফিরে যায় মূল উৎসে আল্লাহর কাছে। কারণ, তিনিও সালাম। তার অন্যতম নাম সালাম।

প্রত্যেক নামাজ শেষে সেই সালামের শিরনি বিতরণ হয়, মসজিদে, মহল্লায় একে অপরে, সমাজের সর্বত্র। শুধু ইহলোক নয়, কবর জগতেও অভিবাদনের ভাষা সালাম। তাই কবর জিয়ারতে গিয়ে আমরা প্রথমেই বলি, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর’। পরকালে বেহেশতেও অভিবাদনের ভাষা হবে সালাম। আল্লাহ পাক বলেন, ‘জান্নাতে তাদের সম্ভাষণের ভাষা হবে সালাম।’ (সূরা ইবরাহিম : ১৪/২৩)। সালামের সূত্রে আমরা সৃষ্টিলোকে বিরাজিত ঐকতানের সঙ্গে একাকার হয়ে যেতে পারি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ইতিহাস ও ঐতিহ্যময় সালাম সৃষ্টির শুরুতে আদম (আ.) থেকে

আপডেট টাইম : ০৩:২৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের মাঝে যে সালামের প্রচলন তার সূচনা সৃষ্টির শুরুতে আদম (আ.) থেকে। সব নবী-রাসুল এই সালামের পরিচর্যা করেছেন। কাজেই আমরা যখন পরস্পর সালাম বিনিময় করি তখন শুধু একে অপরের জন্য শান্তিই কামনা করি না; বরং মানব ইতিহাস ও সভ্যতার সঙ্গে নিজের চেতনাকে শামিল করি। তার মানে সালামের চর্চা আমাদের বিশ্বসভ্যতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে একাকার করে। আমরা নবী-রাসুলদের আচরিত সংস্কৃতির মাঝে মিশে যাই

বিদেশের মাটিতে প্রথম পা রেখে প্রত্যেকের মাথায় চিন্তা জাগে দুইটি কীভাবে নিজের পরিচয় তুলে ধরব, তারপর কী করে পরিচিত কাউকে খুঁজে বের করব। সমস্যাটি প্রকট হয় যখন কেউ এমন কোনো দেশে ভ্রমণে যায়, যেখানকার ভাষা তার জানা নেই কিংবা তার মুখের বুলি কেউ বোঝে না। এই সংকটের অবসান ঘটিয়ে পরবাসীর জন্য নানা সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে একটি বাক্য।

তা হচ্ছে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’। ইসলামী সংস্কৃতির সৌন্দর্যের বাহন এই সালামে প্রথম প্রকাশ পায় ব্যক্তির পরিচয়। অর্থাৎ তিনি মুসলমান। সঙ্গে তার চিন্তা, বিশ্বাস, রুচি-প্রকৃতির পরিচয় ফুটে ওঠে স্বাগতিকদের কাছে। এরই আলোকে তার থাকার, খাওয়ার ও অবস্থানের সুব্যবস্থা হয়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে সালামের এ গুরুত্বের ব্যাখ্যা এমন এক ভুক্তভোগীর, যিনি এমন দেশে মেহমান হয়েছিলেন, যে দেশের ভাষা তিনি বা তার ভাষা তারা জানত না।

মানব সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারায় সালামের এ গুরুত্ব আরও তাৎপর্যময়। ছোটবেলায় জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম শিক্ষকের সঙ্গে। কষ্টিপাথরের ভাঙা পায়ার ওপর পুরনো পালঙ্কের যত দেখে জানতে চেয়েছিলাম, এ ভাঙা খাটের এত কদর কেন? জাদুঘরের খোপে খোপে ভাঙাচোরা হাঁড়ি-পাতিলগুলো এভাবে সংরক্ষণ করার কারণ কী? তিনি বুঝিয়ে বলেছিলেন, এগুলো প্রততাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্যেক জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সারণি। এগুলো প্রমাণ করে একটি জাতির অতীত কত সমৃদ্ধ, ইতিহাস কতখানি গৌরবময়।

উদাহরণ দিয়ে বললেন, যে গাছের শিকড় যত গভীরে প্রোথিত, সে গাছ তত শক্ত, প্রবল ঝড়-ঝাপটা তার ভিত নাড়াতে পারে না। একটি জাতির অবস্থাও এ গাছের মতো। যে জাতির ইতিহাস যত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ, বিশ্ব সভায় সে জাতির উন্নত শিরে দাঁড়ানোর অধিকার তত বেশি। ভিন্ন জাতির আগ্রাসন বা সংকটের মোকাবিলায় শিখর হিমাদ্রির মতো শির-উন্নত থাকে সে জাতির প্রতিটি সদস্যের। আর ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনার উপাদান হচ্ছে জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত-সামগ্রী। এ জন্যই উন্নত জাতিগুলো প্রততত্ত্ব গবেষণায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে দ্বিধা করে না।

এ ক্ষেত্রে ফোকলোর ও লোকাচারগুলোর গুরুত্বও অপরিমেয়। কোনো গবেষক যদি উদ্ঘাটন করতে পারেন, ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মানব জাতির পারস্পবিক অভিবাদন রীতি কী ছিল, নিঃসন্দেহে তা হবে বর্তমান সভ্যতার জন্য বিরাট অর্জন। এ প্রেক্ষাপটে আবহমান কাল থেকে মানব সমাজে বিরাজিত সালামের গুরুত্বও নিশ্চয়ই অপরিসীম। কারণ মানব জাতির সৃষ্টির সূচনা থেকে সভ্যতার বাঁকে বাঁকে সালাম তার আবদান বিলিয়ে আসছে।

পৃথিবীতে প্রধান তিনটি ধর্ম ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্ম। ইসলামের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.)। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক ঈসা (আ.) বা যিশু আর ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক মুসা (আ.)। নবীজির আদি পিতা ইসমাঈল (আ.) আর ঈসা ও মুসা (আ.) এর আদি পিতা ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের আদি পুরুষ ইয়াকুব (আ.)। ইসমাঈল (আ.) ও ইয়াকুব (আ.) ছিলেন ইবরাহিম (আ.) এর দুই ছেলে। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের দাবি, তারা ইবরাহিম (আ.) এর অনুসারী। কিন্তু আল্লাহ পাক কোরআন মজিদে বলেছেন, মুুসলমানরাই ইবরাহিমের প্রকৃত অনুসারী। এতখানি ভূমিকার উদ্দেশ্য এ তথ্য ও সত্যটি তুলে ধরা যে, হাজার হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সম্ভাষণ ও অভিবাদনের ভাষা ছিল সালাম।

এ সাক্ষ্য জগতের সবচেয়ে নির্ভুল ও সন্দেহাতীত গ্রন্থ কোরআন মজিদের। ‘ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানের খবর কি তোমার কাছে পৌঁছেছে? যখন তারা তার কাছে এলো, তাকে তারা সালাম করল। সেও তাদের বলল, সালাম।’ (সূূরা আজ-জারিয়াত : ২৪)।

মেহমানদ্বয় ছিলেন ফেরেশতা। এসেছিলেন মানুষের রূপ ধরে একটা সুসংবাদ নিয়ে। শুধু ইব্রাহিম (আ.) নন, সব পয়গম্বরের জমানায় সালামের প্রচলন ছিল মানব সমাজে। কোরআন মজিদে সূরা সাফফাতে আল্লাহ তায়ালা হজরত নূহ, ইবরাহিম, মুসা, হারুন প্রমুখ নবীকে সালাম জানানোর কথা উল্লেখ করেছেন। (সূরা সাফফাতে : ৭৯, ১০৯, ১২০)। মানব সভ্যতার গোড়াপত্তনের শিকড় সন্ধানে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। যেতে চাই একেবারে শুরুতে। আদি পিতা আদম (আ.) এর জমানায়। বিস্ময়করভাবে আমরা দেখব যে, সালামের প্রবর্তন হয়েছে তারই মাধ্যমে।

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ.) কে তার আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন। তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তায়ালা যখন তাকে সৃষ্টি করলেন, বললেন, যাও এবং অবস্থানরত ফেরেশতাদের এ দলটিকে সালাম করো। আর তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয় শোন। তাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম-সম্ভাষণ রীতি।’ তখন তিনি গিয়ে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’ (আপনাদের প্রতি শান্তিবর্ষিত হোক)। তারা জবাবে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ (আপনার প্রতিও শান্তিবর্ষিত হোক আর আল্লাহর রহমত)।

নবীজি (সা.) বলেন, ফেরেশতারা ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বাক্যটি বৃদ্ধি করলেন। হজরত (সা.) আরও বলেন, অতএব যে লোকই বেহেশতে প্রবেশ করবে সে আদমের আকৃতিতে হবে এবং তার উচ্চতা হবে ষাট হাত। তখন থেকে এ পর্যন্ত সৃষ্টিলোকের উচ্চতা হ্রাস পেয়ে আসছে। (হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে বোখারি ও মুসলিমের বরাতে মিশকাতে)।

আদমকে (আ.) আল্লাহ তায়ালা তার আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন কথাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে চাইলে বলতে হবে আদম (আ.) এর আসল আকৃতিতে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে আকৃতি এখন সাড়ে তিন হাতে ঠেকেছে। বোঝা গেল আমাদের মাঝে যে সালামের প্রচলন তার সূচনা সৃষ্টির শুরুতে আদম (আ.) থেকে। সব নবী-রাসুল এই সালামের পরিচর্যা করেছেন। কাজেই আমরা যখন পরস্পর সালাম বিনিময় করি তখন শুধু একে অপরের জন্য শান্তিই কামনা করি না; বরং মানব ইতিহাস ও সভ্যতার সঙ্গে নিজের চেতনাকে শামিল করি। তার মানে সালামের চর্চা আমাদের বিশ্বসভ্যতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে একাকার করে। আমরা নবী-রাসুলদের আচরিত সংস্কৃতির মাঝে মিশে যাই।

ফুল আমাদরে চোখ জুড়ায়। সালাম আমাদের প্রাণ জুড়ায়। যার মনে শান্তি বিরাজিত, টেনশন-অস্থিরতা নেই, অন্যের জন্য শুভ কামনায় যার মন পুলকিত, সে-ই শুধু অন্যকে সালাম দিতে পারে। তার মনের প্রশান্তি ও ভালোবাসা উপহার দেয় অন্যজনকে, সমাজ ও সভ্যতাকে। শান্তি ও ভালোবাসার সওগাত নামে তখন সমাজে বেহেশত থেকে। আবার ফিরে যায় মূল উৎসে আল্লাহর কাছে। কারণ, তিনিও সালাম। তার অন্যতম নাম সালাম।

প্রত্যেক নামাজ শেষে সেই সালামের শিরনি বিতরণ হয়, মসজিদে, মহল্লায় একে অপরে, সমাজের সর্বত্র। শুধু ইহলোক নয়, কবর জগতেও অভিবাদনের ভাষা সালাম। তাই কবর জিয়ারতে গিয়ে আমরা প্রথমেই বলি, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর’। পরকালে বেহেশতেও অভিবাদনের ভাষা হবে সালাম। আল্লাহ পাক বলেন, ‘জান্নাতে তাদের সম্ভাষণের ভাষা হবে সালাম।’ (সূরা ইবরাহিম : ১৪/২৩)। সালামের সূত্রে আমরা সৃষ্টিলোকে বিরাজিত ঐকতানের সঙ্গে একাকার হয়ে যেতে পারি।